বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৩১ অপরাহ্ন
সাজ্জাদ আকবর।।
আল-জাজিরার ইতিহাসের অন্যতম উপভোগ্য টকশোটা হয়েছে গত মঙ্গলবার (২১ জুলাই)। বিষয় ছিল আয়া সোফিয়া। উপস্থিত ছিলেন আরব মিডিয়ায় তুরস্কের অন্যতম প্রতিনিধি সাংবাদিক হামযা তেকিন। যাকে তুরস্কের বর্তমান ইসলামপন্থী ক্ষমতাসীন দলের একান্ত ঘনিষ্ঠ বলে মনে করা হয়। তার বিপক্ষে ছিলেন সিরিয়ার কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ওয়াইপিজি সমর্থক ও জার্মান অভিবাসী আবদুল মাসীহ শামী।বিজ্ঞাপন
টকশোর শুরু থেকেই আরব মিডিয়ায় তুরস্কের অন্যতম প্রতিনিধি সাংবাদিক হামযা তেকিন আয়া সোফিয়ার মসজিদ রূপে ফিরে আসার পক্ষে যে ঐতিহাসিক দলিলগুলো দিচ্ছিলেন বিভিন্ন ওরিয়েন্টালিস্ট ও খ্রিষ্টান ঐতিহাসিকদের উদ্ধৃতি থেকে, তাতে পুরো টকশোতে শামীর চোখ মুখ লাল হওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। হামযা তেকিনের উল্লেখ করা ঐতিহাসিক দলিল ও বাস্তবতার জবাবে সিরিয়ার কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ওয়াইপিজি সমর্থক ও জার্মান অভিবাসী আবদুল মাসীহ শামী একনায়কবাদী মিডিয়ার শেখানো বুলিগুলোই আওড়েছেন বারবার। কিন্তু সেসবে আর কতক্ষণ? শেষ পর্যন্ত টকশোর মাঝখান থেকেই অপমানিত হয়ে স্টুডিও ত্যাগ করেন আরব একনায়কদের অন্যতম এই প্রতিনিধি। অথচ কয়েক মিলিয়ন মানুষ সরাসরি লাইভ দেখছিলেন টকশোটি। পুরো আরব জাহানের আলোচিত আল জাজিরার সাপ্তাহিক এ টকশোটির দর্শক ও ফলোয়ার কম করে হলেও পাঁচ মিলিয়ন।
যাহোক, আবদুল মাসীহ তার জবাবে মুখস্ত যে বুলিগুলো আওড়েছেন তার সারাংশ হলো, আয়া সোফিয়ার মসজিদ রূপে ফিরে আসার কোনো তাৎপর্য নেই। বরং এটা হল এরদোয়ানের রাজনৈতিক এজেন্ডা এবং নিজেকে মুসলিম জাহানের রক্ষাকর্তা হিসেবে উপস্থাপনের ঘৃণ্য কৌশল। তা না হলে ইসরায়েলের হাত থেকে আল আকসা উদ্ধারের জন্য তুর্কি বাহিনী কেন পাঠান না তিনি ?
আয়া সোফিয়া নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা সমালোচনা কম হচ্ছে না। সেসব আলোচনায় ওঠে আসছে অনেক ইতিহাস ও বাস্তবতা। কিন্তু সাংবাদিক হামযা তেকিন টকশোতে যে সব পর্যালোচনা সামনে নিয়ে এসেছেন, তাতে ফুটে ওঠে পাশ্চাত্যের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নয়া তুরস্কের গভীর সাংস্কৃতিক উত্থানের দৃশ্যপট। আগ্রহী বন্ধুদের জন্য এখানে টকশোটির সারসংক্ষেপ তুলে আনার চেষ্টা করছি :
শত শত মসজিদ যেখানে খালি পড়ে থাকে মুসল্লির অভাবে, সেখানে বিতর্কিত স্থানকে মসজিদ বানানোর মানে কী?
আবদুল মাসীহের এমন অভিযোগের জবাবে হামযা তেকিন দুটি দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখ করেন-
প্রথমত: খোদ ওরিয়েন্টালিস্ট ও খ্রিষ্টান ঐতিহাসিকদের তথ্যমতে আয়া সোফিয়া ছিলো বাইজেন্টাইন সম্রাটের ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পদ। সাধারণ খৃষ্টানদের ওয়াকফকৃত সম্পদ ছিলো না সেটা। এ কারণেই সম্রাটকে পরাজিত করার পর এর মালিকানা পূর্ণরূপে সুলতান মুহাম্মদের নিকট চলে এসেছে। আর সুলতান তার মালিকানাধীন এ সম্পদকে আল্লাহর ঘর মসজিদের জন্য ওয়াকফ করে দিয়েছেন। এ কারণে মসজিদ ছাড়া ভিন্ন উদ্দেশ্যে এর ব্যবহার রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক ও ধর্মীয় সব দৃষ্টিকোণ থেকে আইনত অবৈধ।
আরো পড়ুন: আয়া সোফিয়ার মসজিদে প্রত্যাবর্তন, ইতিহাস ও ইসলামের আয়না
দ্বিতীয়ত: তুরস্ক এখন ১০০ বছর আগের মতো ইউরোপের কোন রুগ্ন দেশ নয় যে পশ্চিমাদের ইশারা ছাড়া কিছু করতে পারবে না। এ কথার জানান দেওয়া আয়া সোফিয়াকে তার মূলে ফিরিয়ে আনার অন্তর্নিহিত কারণ। আজকের তুরস্ক একশো বছর আগের নতজানু তুরস্ক নয়। যাকে নানান চুক্তি আর শৃঙ্খলা দিয়ে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল পশ্চিমারা। বরং একুশ শতকের পৃথিবীতে মাথা উঁচু করা এক বিশ্বগর্বী রাষ্ট্রের নাম তুরস্ক, যে তার আধুনিকতার সাথে গৌরবময় ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটাতে চায়। প্রযুক্তি, সমর ও অর্থনীতিতে আলোর গতিতে এগোচ্ছে তুরস্ক। আন্তর্জাতিক সমস্ত রিপোর্টের তথ্যমতে, এই করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও তুরস্ক আগামী বছরগুলোতে পৃথিবীর শীর্ষ দশ অর্থনীতিতে জায়গা করে নেবে। তুরস্ক এখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন আর ন্যাটোর ধার ধারে না। বরং তুরস্ক ছাড়া ন্যাটো অচল। নয়া তুরস্কের এই বহুমুখী উত্থানের জানান দেওয়া আয়া সোফিয়াকে মসজিদে ফিরিয়ে আনার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য।
বিজয়ের পর সুলতান মুহাম্মদ কি কনস্টান্টিনোপলে আগ্রাসন চালিয়েছিলেন?
আবদুল মাসীহ যখন উসমানীদের আগ্রাসী বলে উল্লেখ করছিলেন, হামযা তেকিন তার জবাব দেন খোদ খ্রিষ্টান ঐতিহাসিক ও দার্শনিকদের বক্তব্য তুলে এনে। যেখানে ফরাসী দার্শনিক ভলতেয়ার নিজেই জানাচ্ছেন -আমরা যেমনটা ধারণা করি, উসমানিরা কখনোই খ্রিষ্টানদের প্রতি কোন ধরনের বৈষম্যমূলক কিংবা অসদাচরণ করেননি। বরং যেখানে ইউরোপ তার ভূখণ্ডে একটি মসজিদ নির্মাণের অনুমতি দিত না, সেখানে উসমানিরা গ্রীকদেরকে দিয়েছে ইচ্ছেমত গীর্জা-চার্চ নির্মাণ ও ধর্মপালনের অবারিত অধিকার। অন্যদিকে ব্রিটিশ প্রাচ্যবিদ থমাস ওয়াকার আর্নল্ড তার বিখ্যাত বই ‘দ্য প্রিচিং অব ইসলামে’ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন, বাইজেন্টাইন সম্রাটের অধীনে থাকা খ্রিষ্টানদের চেয়ে সুলতান মুহাম্মদের ছায়ায় বসবাস করা খ্রিষ্টানরা অধিকতর নিরাপত্তা ও সম্মানের জীবনযাপন করেছে। এতো গেলো প্রাচীন ঐতিহাসিকদের বক্তব্য। বর্তমান সময়ের খ্রিষ্টান নেতৃত্ব কী বলে, তাও উল্লেখ করেছেন হামযা তেকিন। মুসলিম–খ্রিষ্টান ধর্মীয় সংলাপের অন্যতম সংগঠন এপিস্কোপাল কমিটির সেক্রেটারি জেনারেল লেবাননের ওয়াট লং উসমানীদের অধীনে থাকা খ্রিষ্টানদের ইতিহাস উল্লেখ করে বলেছেন, খ্রিষ্টানরা উসমানীদের আমলে পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ইনসাফপূর্ণ নাগরিক অধিকার ভোগ করেছে। কোন ধরনের নাগরিক বৈষম্য কিংবা অবিচারের সম্মুখীন তারা হয়নি।
আয়া সোফিয়াকে কেন্দ্র করে মুসলিম–খ্রিস্টান ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট করছেন এরদোয়ান?
এমন প্রশ্নের জবাবে হামযা তেকিন বলেন, কীসের সম্প্রীতির কথা বলা হচ্ছে? যে গ্রীসের রাজধানীতে একটি মাত্র মসজিদ নেই এখন পর্যন্ত, সেই গ্রীসের তুরস্ককে সম্প্রীতি শেখানোর চেষ্টা চরম লজ্জার। টকশোতে বেশ কিছু প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করে হামযা তেকিন বলেন, এই দেখুন– প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে মুসলিমদের যেভাবে সম্মানিত করেছেন এরদোয়ান, সেভাবে খ্রিষ্টানদেরও করেছেন। গত কয়েক বছরে জনসংখ্যার মাত্র ১ ভাগ খ্রিষ্টানের জন্য নির্মাণ করেছেন ৪৫০ টি নতুন গীর্জা। খ্রিষ্টান বিশপদের সাথে নিয়ে নিজে সেগুলোর উদ্বোধনও করেছেন তিনি। যেখানে ইউরোপের দেশে দেশে ইসলামফোবিয়া ছড়ানো হচ্ছে, মুসলিম বেশভূষার কারণে অফিসে, রাস্তাঘাটে এমনকি মসজিদে আক্রান্ত হচ্ছে মুসলিমরা সেই ইউরোপ কীভাবে তুরস্ককে সম্প্রীতি শিখাবে। এর বিপরীতে তুরস্কের কোনও একজন খৃষ্টান নাগরিক আজ পর্যন্ত নূ্ন্যতম বৈষম্যের স্বীকার হওয়ার রেকর্ড ইতিহাসে নেই।
আজকে বলা হচ্ছে, আয়া সোফিয়ার ঘটনায় পোপ ব্যথিত হয়েছেন। তাকে উদ্দেশ্য করে বলতে চাই। অবশ্যই আপনার ব্যথিত হওয়া দরকার। আমরা একশোটি বছর ধরে ব্যথায় জর্জরিত হয়েছি। আপনিও হোন। আধুনিক ক্রুসেডের হিংস্রতা নিয়ে যখন হামলা হয় মুসলিম জনপদে, তখন আপনি ব্যথিত হন না কেন? ইসরায়েল যখন শত শত মসজিদ গুড়িয়ে দেয়, তখন আপনি ব্যথিত হন না কেন? এই দেখুন বিখ্যাত ইশবেলিয়া মসজিদ। যেটিকে সন্ধি চুক্তির আওতায় অধিকার করেছিল আপনারই কোন পূর্বসূরি পোপ। কিন্তু সন্ধির নিয়ম ভঙ্গ করে সেই পোপই মসজিদটিকে পরিণত করেছিল গীর্জায়। সেই মসজিদের ব্যাপারে কি আপনার কোন ব্যথা আছে?
শরীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অবৈধ: আয়া সোফিয়া নিয়ে মিসরের আযহারী শায়খদের মন্তব্যের ব্যাপারে কী বলবেন?
ডলারখোর এসব শায়খদের ফতোয়া কোথায় থাকে, যখন জেরুজালেমকে ইসরায়েলের স্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করে ট্রাম্প। আর আরব একনায়কেরা সেই ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য ফিলিস্তিন বিক্রির হাট বসায় বাহরাইনে। এসব পকেট ‘শায়খ’দের কথা বাদ দিন। এই দেখুন ওমানের জাতীয় মুফতি তুরস্কের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাকে এ ব্যাপারে সতর্ক করার পরেও তিনি তার অবস্থান ধরে রেখেছেন। স্বাগত জানিয়েছেন ফিলিস্তিনের অবিসংবাদিত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব রায়েদ সালাহ। এই দেখুন, আফ্রিকার একটি অসচ্ছল রাষ্ট্র তগোর সাধারণ মুসলিমরা আয়া সোফিয়া ফিরে পাওয়ার আনন্দে পশু কোরবানি করছে। তুরস্কের কাছে অভিনন্দন আসছে মালয়েশিয়া থেকে, পাকিস্তান থেকে, ইন্দোনেশিয়া থেকে। একনায়ক আর তাদের দালাল-গোষ্ঠী ছাড়া পুরো আরব জনগোষ্ঠী থেকে। পুরো মুসলিম বিশ্ব থেকে। শুধু তাই নয়, ফিলিস্তিনের অন্যতম খ্রিষ্টান ধর্মীয় নেতা ফাদার ইমানুয়েলও তুরস্কের এই সিদ্ধান্তের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। ফিলিস্তিনের মহামান্য আলেম রায়েদ সালাহর বক্তব্য দিয়ে আমি আমার কথা শেষ করছি। তিনি বলেছেন, ইয়া মুসলিমীন আলাম, ইত্তাহিদু…। হে দুনিয়ার মুসলিমরা, এক হও। যে আহবান শত বছর আগে জানিয়ে গেছেন মজলুম সুলতান আবদুল হামীদ। এ আহবানে সাড়া দিয়ে তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো মুসলিম জাহানে কৌশলগত জোট গড়ে তুলবে। যেন জায়নবাদীরা কতিপয় আরব দোসরদের নিয়ে এ অঞ্চলে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে না পারে।
Islam times